
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক
সংসদ নেতা এবং পার্টি প্রধান একই ব্যক্তি হতে পারবে না : প্রস্তাবে একমত নয় বিএনপি
- আপলোড সময় : ২১-০৪-২০২৫ ০৪:২৯:১০ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২১-০৪-২০২৫ ০৫:০৮:৫৪ অপরাহ্ন


ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে আংশিক পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে বিএনপি, যেখানে বলা হয়েছে, অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিল ছাড়া অন্য যে কোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে। সংস্কার প্রশ্নে গতকাল রোববার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের বৈঠকের মধ্যাহ্ন বিরতিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ কথা জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, “সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে আমরা শুনেছি আস্থা বিল এবং অর্থ বিলের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই একমত। “রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে এবং সরকারের স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করার স্বার্থে আমরা চারটা বিষয় এখানে উল্লেখ করেছি-অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন-এই চারটা বিষয় বাদে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে তাদের বক্তব্য এবং ভোট প্রদান করতে পারবে। তাতে তাদের সংসদ সদস্যপদ বিলুপ্ত হবে না।” বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। সেখানে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে। এই বিধানের কারণে খোদ সংসদেই গণতন্ত্র চর্চা ব্যহাত হচ্ছে বলে মত প্রকাশ করে আসছেন রাজনীতির বিশ্লেষকরা। সেজন্য ৭০ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি বিলোপের দাবিও জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সংঠন। ১০০ নারী আসন সংক্ষণের পক্ষে বিএনপি সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা বলেছি, নারীদের (সংরক্ষিত) আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ তে উন্নীত করার সুপারিশের ব্যাপারে আমরা একমত। কিন্তু সেটা বিদ্যমান পদ্ধতিতেই মনোনয়ন হবে; সেটা আমাদের প্রস্তাবে বলেছি। “তবে এটা (নারী আসন সংখ্যা উন্নীত করা) আমরা বলেছি, আগামী পার্লামেন্ট গঠন করার পরেৃ যখন তিনশ আসনে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হবে এবং সংসদে এ সংক্রান্ত সংশোধনী গৃহীত হয়ে বর্তমানের ৫০ এবং আরো ৫০ নিয়ে ১০০ গঠিত হবে, সেই ৪০০ সদস্য বিশিষ্ট সংসদে বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করে কোন পদ্ধতিতে তার পরবর্তী সংসদে নারী আসনের নির্বাচনটা হবে তখন সংসদে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।বর্তমানের জন্য বিদ্যমান পদ্ধতিই আমরা মনে করেছি যে সঠিক।” নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২১ করার প্রস্তাবে বিএনপি দ্বিমত পোষণ করেছে বলে জানান সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, “সকল (সংসদীয়) স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে বিরোধী দল থেকে নেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। আমরা বলেছি, এটা সংসদের প্র্যাকটিস ও সংসদের ওপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত। “তবে আমরা এভাবে একমত হয়েছি যে, কিছু কিছু স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে, যেমন পাবলিক আন্ডারটেকেন কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি-এই জাতীয় কিছু কমিটিতে বিরোধী দলের মধ্যে থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করা যায়; এই বিষয়ে একমত হয়েছি।” সংসদ নেতা ও পার্টি প্রধান এক ব্যক্তি নয়? সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংসদ নেতা এবং পার্টি প্রধান একই ব্যক্তি হতে পারবে না বলে প্রস্তাব করেছে কমিশন, এর সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। “আমরা এটা ওপেন রাখতে বলেছি। অপশনটা পলিটিক্যাল পার্টির এবং মেজরিটি পার্টি অব দ্যা পার্লামেন্টের। কারণ সেই মেজরিটি পার্টির নেতা আর সংসদীয় দলের নেতা সেটা অন্য বিষয়। পার্লামেন্টের ভেতরের বিষয় না। “আর পার্টির যিনি প্রধান, তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না-এই প্র্যাকটিসটা তো আমরা দেখি না। আমরা যদি ওয়েস্ট মিনস্টার টাইপ অব গভার্নমেন্টে দেখি, ব্রিটেনের বর্তমান প্র্যাকটিস দেখি যে, পার্টি চিফ প্রধানমন্ত্রী হন।” এই বিএনপি নেতা বলেন, “এটা একটা ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিস, তাতে কোনো অসুবিধা নাই। সেটা পার্টির স্বাধীনতা, সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা, ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিসের স্বাধীনতা। সুষ্ঠু ভোটে যে সংসদ নির্বাচিত হবে, সেখানে আমাদের মনে রাখতে হবে জনগণ কাকে চায়। জনগণ হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।সুতরাং সেটা পার্লামেন্ট মেম্বার ও মেজরিটি পার্টির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করা উচিত।” সালাহউদ্দিন জানান, সংসদের উচ্চ কক্ষে আসন সংখ্যা ১০০ তে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছে বিএনপি। “উচ্চ কক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি, কারা আসবে, আনুপাতিক হারে আসবে কিনা সে বিষয়ে বিএনপি বলেছে যে, আগে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সংশোধনীটা সংসদে গৃহীত হোক, দ্বি-কক্ষ গঠন হলে পরে সংসদে আলাপ করে নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করা ভালো হবে।” আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো প্রাথমিকভাবে সংসদে উপস্থাপনের কথা বলেছে কমিশন। “আমরা বলেছি, এটা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। তাহলে কোনো চুক্তি রাষ্ট্রৃ যেমন বাণিজ্যিক চুক্তি আছে, বাইলেটারাল চুক্তি, বিনিয়োগ চুক্তি আছে, যেগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নরমাল প্র্যাকটিস করা হয়। চুক্তির পরে সংসদে উপস্থাপনের যে বিধান, যেটা আমরা যেন প্রয়োগ করি। এক্ষেত্রে আমরা বলেছি যে, ডিফেন্স যেসব চুক্তি হয়ে থাকে যেগুলোকে আমরা বলি যে, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চুক্তি সেগুলো ক্লোজড সেশনে করাটাই উত্তম।” ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়ে বিএনপি বিদ্যমান আইন যুগপোযোগী করার সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়েছে বলে জানান সালাহউদ্দিন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়বে? সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা বলেছি যে, রাষ্ট্রপতিকে কী কী বিষয়ে ক্ষমতায়িত করে আইন প্রণয়ন করা যায় সেসব কিছু বিষয়ে এবং নিয়োগের কিছু বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। সেগুলো নতুন আইন প্রণয়ন করে সংসদ প্রণীত করা যাবে। সেক্ষেত্রে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স এবং রাষ্ট্রপতির আরো ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হবে।” তবে ‘ন্যাশনাল কন্টিস্টিটিউশন কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা একটা নতুন ধারণা বাংলাদেশের পলিটিক্যাল কালচারে বা সংসদীয় কালচারে, যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উভয় কক্ষের স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতিসহ আরও কয়েকজনের কথা বলা আছে। এই বডিটার হাতে রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষমতা-যেমন সব কমিশন, তিন বাহিনী প্রধান থেকে শুরু করে পিএসসি, দুদকসহ আরও যেসব সাংবিধানিক পদ আছেৃ এগুলো আমরা একমত নই। “কারণ আমরা মনে করি, তাতে রাষ্ট্রের এক্সিকিউটিভ ফাংশনটাকে এত বেশি লিমিট করা হবে যে এক্সিকিউটিভ বা প্রধানমন্ত্রী যে নামেই ডাকি, তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা দায় হয়ে যাবে। অথচ দায়িত্বটা থাকবে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে জনগনের কাছে এবং সংসদে কাছে, অথচ তার কাছে তেমন কোনো পাওয়ার দেওয়া থাকল না।” বিএনপি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর রাখা পক্ষেই মত দিয়েছে বলে জানান সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, পরপর দুইবারের বেশি কেউ একজন প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যদি দুই বারের পর একবার গ্যাপ হয় তার পরবর্তীকালে জনগণ যদি সেই দলকে নির্বাচিত করে সেই পার্টি মেজরিটি পেয়ে যদি ডিসাইড করে তাহলে সেই একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতেও পারেন।” “কিন্তু কথা হচ্ছে যে, কেন আপনারা ধরে নিচ্ছেন যে, সেইম লিডার বার বার হবেন। আমরা অপশনটা রাখতে চাই ৃ বাধ্য করা যাবে না।” কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার? সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত নয়, তারপরও নির্বাচন আয়োজনের সময় তারা প্রয়োজনের খাতিরেই ৯০ দিনের জন্য অনির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব দিতে চান। “দিস ইজ ডকট্রিন অব নেসেসিটি। আমাদের পলিটিক্যাল হিস্ট্রিতে ও কালচারে দেখা গেছে উইথআউট কেয়ারটেকার গভার্নমেন্ট আমরা কোনো ইলেকশনই অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু করতে পারি না। “যতদিন পর্যন্ত আমরা সেই কালচারে উন্নীত হতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকারের বিধানটা রাখা উচিত। এই ভোটের জন্য আমরা ১৫ বছর আন্দোলনও করেছি।” নজরুল ইসলাম খান বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনা করছি। আলোচনা অব্যাহত আছে, মোটামোটি ভালো এগুচ্ছে। বেশ কিছু বিষয়ে কাছাকাছি এসেছি, বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের দ্বিমত আমরা বলেছি। “আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে এটাই স্বাভাবিক। আমরা বাকশালে বিশ্বাস করি না যে এমন কিছু করা হবে যে এটা সবাইকে বাধ্য হওয়া লাগবে। আমরা মনে করি, দেশ ও জনগণের স্বার্থ চিন্তা করে যা সংঘত যা সর্বাপেক্ষা উত্তম তেমন কিছুই হওয়া উচিত, তেমন কিছুই করা উচিত।’’ গতকাল রোববার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে বিএনপির প্রতিনিধি দল। সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ